প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘটে অঘটন

রফিকুল ইসলাম, উখিয়াঃ


আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার কথা আলোচনায় উঠলেই ক্যাম্প গুলোতে ঘটে কোন না কোন গুরুতর অপরাধের ঘটনা। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা হত্যা, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে স্হানীয় আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ, শৃংখলা প্রভৃতি মূলতঃ নির্ভর করছে অবৈধ আর্থিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে। অনুসন্ধানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশী-বিদেশী শতাধিক এনজিও, ডজনেরও বেশি বেআইনি রোহিঙ্গাদের সংগঠন আর্থিক অনিয়মের মেতে উঠেছে।

এতে ক্যাম্পগুলোতে মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাদক ও মানব পাচার, অপহরণ, খুন,ঘুম,চাঁদাবাজি, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, ত্রাণের পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের মত গুরুতর অপরাধ সিন্ডিকেটগুলো।

জাতিসংঘসহ দেশী-বিদেশী এনজিও গুলো প্রত্যাবাসন ও ক্যাম্পের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধকরণের কোন উদ্যেগ নিয়েছে বলে জানা নেই। কিন্তু সেবা সংস্থাগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ম আশ্রিত উদ্বাস্তু মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধিকরণে ভূমিকা পালন করা। পাশাপাশি আশ্রিত উদ্বাস্তুদের নিজ নিজ আবাসভূমে নিরাপদে ফেরত যেতে উদ্বুদ্ধকরণ। কিন্তু এধরণের কোন উদ্যেগ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জাতিসংঘসহ এনজিওগুলো করছে বলে রোহিঙ্গাদের জানা নেই।

বরং সেবা সংস্থা গুলো উল্টো তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্যেগত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ লালনের পরিবর্তে উচ্ছৃঙ্খল করে গড়ে উঠতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে চাপা উত্তেজনা চলছে। কার্যত এসব অপসংস্কৃতি ও ধর্মীয় উচ্ছৃঙ্খলা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে রোহিঙ্গারা স্ব উদ্যেগে একাধিকবার দেশে ফেরত যাওয়ার উদ্যেগ নিয়েছিল। তাদের মতে,যখনই এধরনের আলোচনা চলে তখনই গুরুতর কোন অঘটন ঘটানো হয় ক্যাম্পগুলো ও রাখাইনে রোহিঙ্গা বসতি এলাকাতে।

তদ্রুপ গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮ টায় তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে উদ্বাস্তু জীবনের পরিবর্তে নিজ দেশে ফেরত উদ্যেগ নেয়ায় প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় শীর্ষ নেতা মাষ্টার মুহিবুল্লাহকে গুলি করে খুন করা হয়। এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সংগঠন এআরএসপিএইচ এর কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ঐ সভায় মিয়ানমার জান্তা বিরোধী গঠিত ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ কে সংহতি জানিয়ে তাদের সাথে অংশগ্রহণ। নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার লক্ষে রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ও মিয়ানমারের রাখাইনে ৭২৮ টি রোহিঙ্গা গ্রামের প্রত্যেকটিতে ৭ সদস্যের কমিটি গঠনসহ বেশ কিছু গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিছু কিছু কমিটি গঠনও হয়েছে, কিন্তু সাধারণ রোহিঙ্গাদের কল্যাণার্থে গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলো বানচাল করে রোহিঙ্গা সমস্যা জিঁইয়ে রেখে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে এআরএসপিএইচ এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান। এ ষড়যন্ত্রের পিছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের পাশাপাশি মিয়ানমার জান্তার সামরিক গোয়েন্দা “এমআই” এর হাত রয়েছে বলে উক্ত নেতৃত্বের অভিমত।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতির উপর গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে মিয়ানমার থেকে ক্যাম্পগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্র আসছে। সেখানকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘ রোহিঙ্গাদের মাঝে পারস্পরিক আধিপত্যের দ্বন্দ্ব রয়েছে। মাদক পাচারসহ গুরুতর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশ গুলি করার মত কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি সরজমিন পর্যবেক্ষণ গতকাল শুক্রবার থেকে কক্সবাজারে ২ দিনের সফরে রয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অতি সন্নিকটে এ সংকট সমাধানের তেমন কোন উপায় না দেখে স্হানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে হতাশা ও উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। সংকট জিঁইয়ে রাখার পিছনে তারা জাতিসংঘসহ দেশী-বিদেশী এনজিওগুলোকে দায়ী করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বাংলাদেশী লোকজনের যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ার দাবী অনেকের। পরিস্থিতি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোন কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় নিয়ে কোন ধরনের বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

রোহিঙ্গা আশ্রয়ের কারণে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন বিশ্বের অনেক রাস্ট্র, সরকার প্রধান। এসেছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভিভিআইপিগণ ও বৈশ্বিক নামীদামী সেলিব্রিটিরা। এসব বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে মিলেছে আশ্বাসের বুলি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত। কিন্তু বাস্তবে এসময়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অগ্রগতি তলানিতে। এনিয়ে আশ্রয়দাতা স্হানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবনে বাড়ছে দীর্ঘঃশ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (জেডব্লিউজি) গঠন করা হয়। জেডব্লিউজির চতুর্থ ও শেষ বৈঠক হয় গত বছরের মে মাসে মিয়ানমারের নেপিদোতে। বাংলাদেশ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেডব্লিউজির পঞ্চম বৈঠকটি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের নানা বাহনায় তার আর হয়নি।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক উদ্বাস্তু প্রত্যার্পন চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের শেষার্ধে ও ২০১৮ সালের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর দুইবার উদ্যেগ নিয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে অভিযোগ উঠে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিও. গুলোর পরোক্ষ ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গ্রুপের বাধায় তা ভেস্তে যায়।